Tuesday 10 January 2017

আমার কলকাতা... (শিল্প এবং পুরাতন চিন্তাভাবনায়)

               উত্তর কলকাতা এক emotion.... সকলেরই এক উত্তর কলকাতা আছে। কিছু দিন আগে এই রকমই একটা পোস্ট পরেছিলাম ফেসবুকে... আর অনেক দিন ধরেই তো আনন্দবাজার পত্রিকায়ে আমার উত্তর , আমার দক্ষিন বলে লেখা বেরোয়... নামী নামী অনেকে লেখেন। আমি না হয় আমার ব্লগটায় লিখলাম।

              এখানে, অলিগলিতে লুকিয়ে আছে এক অন্যরকম মাদকতা... চায়ের দোকানের সামনে বোর্ডে ,প্রতিদিন , বর্তমান , আনন্দবাজার পত্রিকার সারি...  ঘরে ঘরে ক্লাসিকাল নাচ গানের চর্চা, রকে রকে তুলকালাম রাজনৈতিক আলোচনা... শীতকালে দল বেঁধে পিকনিক... স্পোর্টসের আয়োজন... দুর্গা পুজো , সরস্বতী পুজো... আরও কত কি... বাঙালির খাদ্যরসিকতার কথা না হয় নাই লিখলাম... রসগোল্লা, মিষ্টি দই, রসমালাই, সাথে ইলিশ চিংড়ি আর ইস্ট বেঙ্গল মোহনবাগান... এগুলো ছাড়া তো বাঙালি অসম্পূর্ণ... 

              আর একটা দৃশ্য যেটা আগে দেখা যেত ... এখন সময়ের অভাবে কমতে বসেছে , সেটা হল পায়েরার নেশা... আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই একটা বাড়ি ছিল যেখানে এই রকম পায়েরার ঝাঁক দেখেছি ছোট বেলায় ...... আর বাবার মুখে শুনেছি সেই পায়েরা নিয়ে কত গল্প... দিনের দুটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই পায়েরার ঝাঁক আকাশে উড়ত... কি যে সুন্দর নিয়ম মেনে,  সেটা যারা দেখেননি তারা বুঝতে পারবেন না। তাদের পরিচর্যা , প্রজনন এই সবের জন্য নির্দিষ্ট একজন থাকতো। আর বাড়ির বাবুরা ছুটির দিনে হাটে যেতেন সেই পায়েরা কেনা বেচা করতে। অনেক ধরনের পায়েরা থাকতো... যার কাছে যত ভাল মানের পায়েরা তার তত দর। কত রকমের সেই পায়েরার নাম... 
  • হোমার (উড়াল প্রতিযোগিতায় ব্যবহার হয়)- হোমিং পিজিয়ন থেকে
  • গোলা (দেশী কবুতর)
  • লাক্ষা (সৌখিন, লেজগুলো দেখতে ময়ুরের মত ছড়ানো) - ভারত থেকে এসেছে
  • সিরাজী (সৌখিন ) - লাহোর নামে পাওয়া যায়
  • গিরিবাজ - (উড়ানোর জন্য বিখ্যাত)
  • কাগজি (সমস্ত শরীর সাদা কিন্তু সমস্ত চোখ কালো)
  • চিলা
  • গোররা (শরীর সাদা কালো মিশ্রণ, যেমন মাথা সাদা, পিঠ কালো, ডানা সাদা)
  • চুইনা (সমস্ত শরীর সাদা কিন্তু সমস্ত চোখ কালো নয়)
  • রান্ট
  • প্রিন্স
  • পটার (গলার নিচটা ফুটবলের মতো)
  • ফ্রিল ব্যাক
  • জ্যাকোবিন ... ইত্যাদি... 
               এই সবের মধ্যে লাক্ষা খুব সুন্দর দেখতে, আর হোমার তো দ্রুততম। মাঝে মধ্যে কিছু পায়েরা দলছুট হয়ে গিয়ে অন্য কোন দলে চলে যেত, বাস, তার মালিকের কি আকুতি অনুরোধ অন্য দলের মালিকের সাতে... সেও দেবেনা , আর এ নিয়েই ছাড়বে... বাবা তো বলতই এ এক অদ্ভুত পায়েরা কালচার.........

            সবকটা পায়েরা যখন একসাথে উড়ত কি যে সুন্দর লাগতো... নীল আকাশে সাদা সাদা, কিংবা বাদামী কালো রঙের ... পালক গুলো চকচক করছে ... আমার ছোট্ট মন টা কোথায়ে হারিয়ে যেত। শখ হত... আমিও ওই রকম পায়েরাদাদা হব। আজ সে পায়েরা বসার লম্বা দাঁড় টা আর নেই... আর আমার শৈশব ও যে আর নেই... এখন ছাতে যাই, দেখি এদিক ওদিকে সবকটা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল গড়ে উঠছে... আমার ছোটবেলার সেই নীল আকাশ সেই সব বাড়িগুলোর ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে যেন...... এখন আর ছাতে গিয়ে বসা হয় না... গরমের দিনে লোডশেডিং হয়ে গেলে ছাদে গিয়ে রাতের আকাশে তারা দেখাও হয় না  আর... মানুষ ডিজিটাল হচ্ছে আজকাল... আর সাথে পরিবর্তন হচ্ছে পুরনো কলকাতার...



           তবে ভাললাগে একটা জিনিসই ... পরিবর্তন তো ভাল... কিন্তু শিকড়টা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে যে । সেই দিক দিয়ে কলকাতা আজও তিলোত্তমা... আজ ও অচেনা কোন গলি দিয়ে যেতে যেতে কানে ভেসে আসে সরোদের সুর , কোন অনভ্যস্ত হাতে ভূপালীর আলাপ...  দেখতে পাই নাটক দেখতে এসে আজও একাডেমী কিংবা গিরিশ মঞ্চের টিকিট কাউনটারে লম্বা লাইন... ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনে উপছে পরা ভিড়... আজও বইমেলার প্রাঙ্গনে দেখা যায়, নতুন প্রজন্মকে... গোল হয়ে বসে গীটার হাতে একের পর এক সুমন, নচিকেতা, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দুর গান গাইতে... আজও ভিক্টোরিয়ার সবুজ ঘাস শীতের নরম রোদ গায়ে মাখে......... আজও বাঙালীর সকাল হয় রবি ঠাকুরের গানে, হাতে খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ নিয়ে...আজও স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে ফেরিওয়ালা দুপুর রোদে ডাক দিয়ে যায় ... "পুরানো কাগজ বিক্রি করবেন" কিংবা "দিদি বাসন নেবেন"...


          যখনই আসি এখানে মনে হয় যেন কি এক অপূর্ব শান্তি মনের মধ্যে... খুব ভাললাগে একা একা রাস্তার জনসমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে যেতে... কলেজ স্ট্রিটের বই-এর দোকানে পুরনো বই এর গন্ধ মাখতে...... লঞ্চে দাঁড়িয়ে গঙ্গার হাওয়া খেতে......

সত্যি কলকাতা এক অনুভব ...

যুগ বদলাবে... কত মানুষ আসবে যাবে... কিন্তু তুমি তোমার স্বমহিমায় থেকো কলকাতা...